আহমদ রফিক: যেমন নিঃশব্দে বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের সমাজে তৈরি হয়েছে চরম দুর্নীতি ও অবিশ্বাস্য অপসংস্কৃতির আসর (ক্যাসিনো বাণিজ্য, সঙ্গে মাদক ব্যবসা), তেমনি হঠাৎ করে চমক লাগানো অভিযান এসবের বিরুদ্ধে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে। আপাতদৃষ্টিতে ধুন্দুমারকান্ড। শহর ঢাকায় দেড় শতাধিক জুয়ার আসর, ক্যাসিনো-বাণিজ্য, শত শত কোটি টাকার লেনদেন, যা হাজার কোটিতে উন্নীত।
এসবের মূল নায়ক শীর্ষ যুবলীগ নেতৃত্ব, সেই সঙ্গে সর্বোচ্চ ছাত্রলীগ নেতৃত্ব। নেপথ্য নায়ক, কলম্বিয়ান মাদক সম্রাটদের ভাষায় ‘গডফাদার’ এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ আওয়ামী লীগ নেতা। সবার সামনে, সবার অলক্ষ্যে এই যে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচা এসব অনাচারের চরম পর্যায় নৈশ অপসংস্কৃতি মাদক, জুয়া, ক্যাসিনো আর এসবের প্রাথমিক মধ্যমণি শীর্ষ যুবলীগ নেতা, ছাত্রলীগ নেতা, যাদের নাম এখন প্রতিটি দৈনিকের সুবাদে মানুষের মনে গেঁথে গেছে।
এতসব তুমুল কর্মকান্ড এবং এদের নায়ক তো এক দিনে তৈরি হয় না, তৈরি হয়নি। ধীরে-সুস্থেই তৈরি হয়েছে এবং তা বড় ভাইদের হাত ধরে, যারা পরে একসময় গ্রুপ-বিশেষের ‘গডফাদার’ নামে চিহ্নিত। এরা হয়ে উঠেছে অপরাধ জগতের শিরোমণি। এরা অজেয়, নির্মম, নিষ্ঠুর, বেপরোয়া, ঘাতক, মানবজীবনের মূল্য এদের কাজে এক কানাকড়িও নয়।
রহস্যজনক কারণে হঠাৎ করে এদের লক্ষ্য করে মহাপ্রলয়। র্যাব অভিযান, পুলিশি অভিযান। সংবাদপত্র মহলে তুমুল তোলপাড়। একের পর এক নাম উঠে আসছে। কেউ কেউ গ্রেপ্তার, দন্ড একজন রিমান্ডে, অনেকে নজরদারিতে। আবার কেউ স্বমহিমায় স্বীয় আসনে আসীন। কারও কারও প্রশ্ন: এ মহাসন্ত্রাসী কেন ধরাছোঁয়ার বাইরে? তাকে কেন ধরা হচ্ছে না তার আমলনামা প্রকাশ সত্ত্বেও?
আরও প্রশ্ন পুলিশি অভিযানের ধারা নিয়ে। অভিযান যেন পেশাদারি চরিত্র রক্ষা করতে পারছে না। তাদের প্রশ্ন: পুলিশ তো এত দিন এদের রক্ষাকর্তা, বিধাতা ছিল। তাই শামীম চক্রের দখলদারি নিয়ে সংবাদ শিরোনাম: ‘বান্দরবানে সম্পদের পাহাড়, জিম্মায় ছিল পুলিশ।’ একই ব্যক্তির সম্পদ প্রসঙ্গে অন্য কাগজে শিরোনাম: ‘শামীমের ঘুষের ক্যাশিয়ার পূর্ত মন্ত্রণালয়ের মফিতুর’। আরেকটি খবরের শিরোনাম: ‘পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীর নামে কোটি টাকার সম্পত্তি।’ কী যে সব ঘটছে বাংলাদেশে?
‘অভিযানের ধরন’ নিয়ে যেমন পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তেমনি অভিযোগ ‘ঢাকায় দেড় শতাধিক জুয়ার আখড়া’ দেখভালের নায়কদের নিয়ে। চমৎকার একটি দুর্নীতিবাদী ত্রিভুজ যুবলীগ/ছাত্রলীগ নেতা, রক্ষক পুলিশ, নেপথ্যে গডফাদার রাজনৈতিক নেতা। কে তাদের তৎপরতায় বাধা দেবে কিংবা বাধা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে?
এমন যে এক অবিশ্বাস্য ভয়াবহ ও অসামাজিক, দুর্নীতিবাজ পরিস্থিতির সৃষ্টি কীভাবে তৈরি হলোÑসেটাই আমাদের প্রধান আলোচ্য বিষয়। বাংলাদেশের সংসদীয় নিয়মতান্ত্রিক দ্বিপক্ষীয় রাজনীতির জোটবদ্ধতা যখন দলবিশেষের ভুলত্রুটিতে একদলীয় রাজনীতির শক্তিতে পরিণত হলো, তখন ডুবন্ত জাহাজের প্রবাদমাফিক ইঁদুরগুলোই দ্রুত নিরাপদ অবস্থানে বেরিয়ে আসে। খুঁজতে থাকে আশ্রয়। পেয়ে যায় আশ্রয়-প্রশ্রয় শক্তি মান শিবিরে, ছলে-কৌশলে, কখনো ছদ্মপরিচয়ে, কখনো পরিচয় না লুকিয়ে। তখন আওয়ামী লীগ দলের দু-একজন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নেতার সরস-সতর্ক হুঁশিয়ারি: দলে ‘কাউয়া’ ঢুকে পড়ছে। সাধু সাবধান! কিন্তু সেই সাবধান বাণী গ্রাহ্য হয়নি দলের দুর্দান্ত ক্যাডার ও বেপরোয়া সন্ত্রাসী শক্তি বৃদ্ধির চাহিদা মেটানোর উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্য অর্জন মাথায় রাখার কারণে। তাই লাগাতার একের পর এক দলে ও প্রধানত দলের অঙ্গ সংগঠনে (ছাত্রলীগ, যুবলীগে) ‘কাউয়া’র অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে। ক্রমেই চরিত্র বদল ঘটতে থাকে ওই দুই অঙ্গসংগঠনের। সংগঠনের নেতিবাচক চরিত্র অধিকতর শক্তি মান ও দুর্জয় হয়ে উঠতে থাকে, নীতিগত অবক্ষয়ের ক্রমশ মাত্রা বৃদ্ধি; স্বল্পসংখ্যক নীতিবাদী পিছু হটে বা দুর্বল হয়ে পড়ে তাদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর।
‘কাউয়া’দের কেউ তখন দুর্দান্ত শিকারি চিল-ইগল বা শকুনের মতো মাংসভোজী। এ সম্পর্কে দুই চৌকস সাংবাদিক কাউয়াদের ছোট আমলনামা লিখেছেন এই শিরোনামে: ‘বহিরাগতদের হাতেই নিয়ন্ত্রণ যুবলীগের।’ এই প্রতিবেদনে যুবলীগের প্রধান নেতা হিসেবে বহিরাগত আনিসুর রহমান, জি কে শামীম, ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, এনামুল হক আরমান, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, তসলিম উদ্দিন, শফিকুল ইসলাম শফিক, মোয়াজ্জেম হোসেন প্রমুখ নেতার নাম উদ্ধৃত। একটি দৈনিকে সম্পাদকীয় নিবন্ধেও এদের নাম ও মূল রাজনৈতিক পরিচয় ধৃত।
এরা এবং এদের মতো আরও অনেকে ফ্রিডম পার্টি, ছাত্রদল, জামায়াত-শিবির রাজনীতির সন্তান। সুবিধবাদী ও সুবিধাভোগীর রাজনীতির ধারায় আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনে যুক্ত হয়ে শক্তিমান নেতায় পরিণত। এদের তৈরি করেছে কিছুসংখ্যক অতি উচ্চাভিলাষী আওয়ামী লীগ নেতা। যাদের অর্থবিত্তের লোভ সীমাহীন। তাদের রাজনৈতিক শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় এরা দুর্দান্ত, এরা বেপরোয়া গুম-খুন, অপসংস্কৃতি ও অনৈতিকতার চরম তৎপরতায়। এই প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং দলীয় উপদেষ্টা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এইচ টি ইমাম এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন: ‘চলমান ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে ধরাপড়া সবাই একসময় যুবদল, বিএনপি, জামায়াত অথবা শিবির করত। এরই মধ্যে যাদের ধরা হয়েছে, তারা সবাই অনুপ্রবেশকারী।…তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন: রাজনৈতিক উপদেষ্টার মতো দায়িত্বপূর্ণ পদে থেকে, কাউয়াদের পরিচয় জানা থাকা সত্ত্বেও, বিরোধী দল থেকে আসা বহিরাগতদের অন্তর্ভুক্তিতে তারা বাধা দেননি কেন, প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেননি কেন? আর এ অভিযান শুরু থেকে চালানোর উপদেশ দেননি কেন উপদেষ্টা হিসেবে, যখন দলের কোনো কোনো নেতা এদের ‘কাউয়া’ নামে চিহ্নিত করেছিলেন?
তাহলে আজ দলের ভাবমূর্তি নিয়ে যে প্রশ্ন তা অন্তত এভাবে উঠত না, জন্ম নিত না ক্যাসিনো অপসংস্কৃতির মতো চরম অনৈতিকতা এবং দুর্নীতির ব্যাপক ব্যাধি। পত্রিকায় আওয়ামী লীগ নেতা কারও কারও নাম নিয়ে শিরোনাম-প্রতিবেদন ছাপা হতো না। আমাদের পড়তে হতো না এমন খবর: ‘ক্যাসিনোর টাকায় অঢেল সম্পত্তি আওয়ামী লীগ নেতা দুই ভাইয়ের’।
সবার খবর বা আমলনামা তো এখনো প্রকাশ পায়নি সংবাদপত্রে। ক্যাসিনো সাম্রাজ্যের সুবিধাভোগী গডফাদারদের সংখ্যা তো দেড় শতাধিক জুয়ার আড্ডার বিচারে নেহাত কম হবে না। তাদের নাম কি গোপনই থাকবে, অভিযান তাদের দুর্নীতির আমলনামা প্রকাশ করবে না? প্রশ্নটা করছি এ জন্য যে, প্রধানমন্ত্রী জেনে-বুঝে কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই এই দুর্নীতি ও অনৈতিকতাবিরোধী অভিযানের নির্দেশ দিয়েছেন। ঝুঁকিটা হলো, এতে বেপরোয়া যুবলীগ ও ছাত্রলীগের মতো অঙ্গসংগঠনের শুদ্ধি অভিযানের ইতিবাচক তৎপরতার পাশাপাশি এর নেতিবাচক দিকটিও জনসমক্ষে প্রকাশ পাবে।
অর্থাৎ নেপথ্য নায়ক, গডফাদার আওয়ামী লীগ নেতাদের যথার্থ পরিচয় দলের ভাবমূর্তির ওপর কালো দাগ টানবে। গণতান্ত্রিক রাজনীতির নিয়মমাফিক এদের দল থেকে বহিষ্কার করাই হবে দলের আদর্শিক কর্তব্য। তাতে আপাতদৃষ্টিতে দলের শক্তি ক্ষয় পাবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাতে দলের উপকারই হয়, জনগণের মধ্যে দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়। অনেক অন্যায় মানুষ ক্ষমা করে দেয়। বহিরাগত ‘কাউয়া’দের পাশাপাশি দলের অভ্যন্তরে অবস্থিত, দুর্নীতিগ্রস্ত কাউয়াদেরও এ অভিযানে চিহ্নিত করা উচিত, এরপর বহিষ্কার। অবশ্য এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে, লোম বাছতে গিয়ে কম্বলের অস্তিত্ব নিয়ে যদি টান পড়ে? তাই সীমিত, নির্বাচিত চরিত্রের অভিযানের মাধ্যমে কর্তব্য সমাপন কি লক্ষ্য হয়ে উঠবে? কিন্তু একবার যখন প্যান্ডোরার বাক্স খোলা হয়েছে, তখন সেখানে ‘আমাদের বনাম তাদের’ এ হিসাব-নিকাশ তো যুক্তিতে টিকবে না, ধোপেও টিকবে না। শুদ্ধি অভিযান শুদ্ধভাবেই চালাতে হবে। তাতে জনগণের আকাংক্ষা পূরণ অন্তত এক মাত্রায় হলেও পূরণ হওয়ার কথা। আওয়ামী লীগ কি তা করতে পারবে? সংবাদপত্রগুলোর একটির সম্পাদকীয় মতামতেও এই একই মতামত পরিস্ফুট ‘দেশকে এগিয়ে নিতে হলে দুর্নীতি ও লুটতরাজ বন্ধ করতেই হবে। আমরা চাই অভিযান চলমান থাকুক এবং আরও জোরদার করা হোক।’
জনমতামতও এই দিকে। অর্থাৎ তারা চায় একটি উদাহরণ সৃষ্টি হোক। একটি নিরপেক্ষ, পরিচ্ছন্ন, যুক্তিবাদী, দুর্নীতিবিরোধী, অপরাধবিরোধী অভিযান কার্যকর হোক। তাতে সমাজ সুস্থ পথের দিকে এগোবে, রাজনীতি কলুষমুক্ত হবে। ‘কাউয়া’ শব্দটি যিনি উচ্চারণ করেছিলেন, সেই বহুচেনা মানুষটিকে আজ ধন্যবাদ জানাই।
-লেখক: ভাষাসংগ্রামী ও রবীন্দ্র গবেষক